নিরুদ্দেশ সম্পর্কে ঘোষণা


সে ছিল আমাদের স্কুলজীবনের ইতিহাসের তোষাখানার খাজাঞ্চী। কাল থেকে নিরুদ্দেশ। 


অমুক ছেলে তমুক ক্লাসে কোন সেকশনে পড়তো? তার কাছে নির্ভুল জবাব ছিল। ফাইভ এ আর ফাইভ সি এর ফুটবল ম্যাচের স্কোরটা? এই গুগলের যুগেও ফেলুদাদের সিধু জ্যাঠা ছাড়া গত্যন্তর আছে কি? সেইসব প্রশ্নগুলি কাল থেকে বাতাসে ঘুরপাক খাচ্ছে সঠিক জবাবের সন্ধানে। 

তার একটা হিজিবিজি খাতা ছিল। অনেক অপ্রয়োজনীয় দিনের বিক্ষিপ্ত দিনলিপি। বাজে খরচার হিসেব। প্রবল মান-অভিমানের একপেশে জবানবন্দী। পাতার ভাঁজে বন্ধুদের পাঠানো চিঠি। যত্ন করে রাখা - খাম সমেত। আ্যলবামের ছবির পেছনে খুদে খুদে অক্ষরে দিনক্ষণের হদিশ। কোন স্ট্যাম্প বা কোন কয়েনটা কোন বন্ধুর কাছ থেকে ঝাড়া? একটু অপরাবোধমিশ্রিত লাজুক হাসিতে সেটাও বলে দিত। ওগুলোই বোধহয় ওর জীবনের মূলধন ছিল। সে বন্ধুদের আর বন্ধুত্বকে বড্ড যত্ন করে রাখতো। তাই হয়তো ওর দাবীও ছিল বেশী। উত্তরকালে জীবনশাস্ত্রের দাবী মেনে সবাই যখন ঘোর সংসারী, তার দাবী-দাওয়াগুলি কিন্তু সেই অপাপবিদ্ধ কিশোরের মতোই রয়ে গেছিল। বন্ধুই তো! বলাই যায়। 

তার সঙ্গে প্রথম আলাপ কবে? বিস্মরণের পর্দা সরিয়ে স্মৃতি হাতড়াতে হাতড়াতে দেখি ক্লাস ওয়ানের ক্লাসঘর। দ্বিতীয় বেঞ্চের কোণে বসে সে নতুন নতুন বন্ধুদের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছে দুরন্ত শৈশব। তারপর আ্যলবামের পাতা ওল্টানোর মতো যে দৃশ্যকল্পের এলোমেলো পটপরিবর্তন তার সবগুলিরই অবিসংবিদিত নায়ক সে। কখনো চক হাতে মনিটর। কখনো ফুটবল টিমের ক্যাপ্টেন সেজে মিড ফিল্ড থেকে দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। কখনো বা দেওয়াল পত্রিকার অগ্রনায়ক। অথবা কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞানের রাশি রাশি পাতা থেকে উঠে আসা উত্তরাধুনিক কলিংবেলের ভেল্কি কিংবা এলইডি লাইটের মজার খেলা। আরেকটু বড়ো হয়ে ভ্রমণ পত্রিকার পাতায় পাতায় সে খুঁজছে ছোট্ট করে কোথায় বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে আসা যায়। জগতের আনন্দযজ্ঞে সে নিমন্ত্রণের তোয়াক্কা তো করে নি কখনো! তখনো কোনো নেশা তার আঙুল কিংবা ঠোঁট ছোঁয় নি। জীবনসঙ্গিনী বলতে স্পোর্টস্টারের সংখ্যা থেকে সাবধানে কেটে রাখা স্টেফি গ্রাফের মূহুর্তগুলি। আর ছিল অনেকগুলো দুপুরবেলা। কিছু বই। অনেক স্বপ্ন। কিছুটা অভাব অনটন।অনেকটা বাজে খরচা। কিছু বাউন্ডুলেপানা। অনেকটা স্থৈর্য্য।

তারপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অনেক মান-অভিমান তিক্ততা-রিক্ততা। যে ছেলেটা মাঠে বল পায়ে দৌড়তো, জীবন তাকে দৌড় করিয়েছে নানা প্রতিকূলতায়। তার সব দৌড়ই যে বাহবা কুড়িয়েছে - একথা বলি কি করে? সব কিছু ছাড়িয়ে ভালোবাসানোর অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল তার। ওকে কেউ কখনো না বলতে পারে নি। যে অপিরিসীম জীবনীশক্তি ওর মধ্যে ছিল, জটিল রোগকেও অপেক্ষা করতে হয়েছে বছর দুয়েক। তারপর একদিন হঠাৎ নিরুদ্দেশ। 

কাকে বলে শেষ দেখা? যে পার্থিব শরীরটা একটু পরে পুড়ে যাবে তার ওপর একটুক্ষণ তাকিয়ে থাকা? নাকি আদ্যন্ত জ্যান্ত মানুষটা, যে মৃত্যুশয্যাতেও নিজের রোগকে নিয়ে ঠাট্টা করে গেছে? "কেমন আছিস" - এর উত্তরে যা বলতো শুনলে মনে হতো একজন ডাক্তারবাবু এক রোগীর সম্পর্কে কথা বলছে। গভীর জীবনবোধ আর অসীম মনোবল না থাকলে এ অসম্ভব। প্রতিটা ফোনে, হোয়াটসআ্যপ মেসেজের জবাবে বলতো "ভালো আছি"। 

ভালো ও ছিল না বেশ কয়েকবছর। ভালো থাকার নাটক করতো। দুজনেই জানতাম। আর এটাও জানতাম ভালো থাকার থেকেও থাকাটা হয়তো একটু বেশী গুরুত্বপূর্ণ। শেষ হোয়াটসআ্যপ মেসেজটার কোনো জবাব আসে নি। আশঙ্কা ছিল ও ভালো তো নেই ই, হয়তো নেই ও। 

আসলে তার সঙ্গে আমার শেষ দেখা স্কুলের মাঠে। চোখে অনেক স্বপ্ন। অনেক আশা। অনেক কিছু করার ইচ্ছা। বইমেলায় কেনা নতুন বই। ভ্রমণের নতুন সংখ্যা। সাইকেলটা শিখতেই হবে। কতদিন আর বন্ধুরা টানবে?


Comments