যাত্রী




আসানসোল থেকে বম্বের ট্রেন মাঝরাতেরও ওপারে। মেরেকেটে মিনিট তিনেকের স্টপ। যাত্রী আমরা দুটি। সিনিয়র সিটিজেনের তকমা ওঠা ঠাকুমা আর সদ্য হাফটিকিট আমি।গোছগাছের পালা শেষ হলে বাবা গুনে দেখলেন বাক্স-প্যাঁটরা-পোঁটলা-পুঁটলি-জলের কুঁজো-হোল্ডঅল-বইয়ের সুটকেস-খাবার দাবার-এটা-ওটা-সেটা মিলিয়ে লাগেজের সংখ্যা সতেরটি। ভাগ্যিস গরমকাল! নইলে সংখ্যাটা ডজন দুয়েক ছাড়াতো। 

না-ইনসাফির গব্বরীয় যুক্তি ঠাকুমার কাছে কোনোদিনই ধোপে টেঁকে না। বাবা তো কোন ছাড়! অনেক দরদাম চেঁচামেচি মান অভিমান যুক্তি তক্কোর পর শেষে রফা হলো বারোটায়। এরপর শুধু পার্মুটেশন আর কম্বিনেশনের খেলা। ট্রেনে হাত মোছার ঝাড়ন গেল লুচির কৌটোর ওপরে। উলের ব্যাগটা খালি করে উল গুলো চালান হলো বড়ো সুটকেসের খোলে (আজ্ঞে হ্যাঁ! যে কারণে স্বনামধন্য সাহিত্যিকরা আষাঢ়স্য প্রথম দিবস থেকে শারদীয়ার গপ্পো লিখতেন, ঠাকুমাও সেই কারণেই গরমের ছুটিতে সোয়েটার বুনতেন)! ন নম্বরের কাঁটা গুলো বড়ো পেন্সিল বাক্সে। দশের ওপরের নম্বরের গুলো কোথাও একটা শরণার্থী। মুজতাবা আলীর সেটটা থেকে "শবনম" বাদ পড়লো। গোটা তিনেক শাড়ী জামা কাপড় এ সুটকেস ও সুটকেস আলমারী হয়ে ফের ও সুটকেসে। মোদ্দা কথা কসমস থেকে ক্যাওস! ঠাকুমার মুখ হাঁড়ি। বাবা ঘামে জবজবে। মা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ভাই আর আমার বাৎসরিক বিনোদন!

সে বহুযুগ আগের কথা। কখনো কখনো গতজন্ম বলেওভুল হয়। ষাটোর্ধ এক বৃদ্ধার বছর ছয়েকের বাচ্চাকে নিয়ে কয়েক হাজার মাইল ট্রেনে যাত্রা করার জন্য যে জিনিসটা লাগতো অভিধানে তার নাম দিয়েছে বিশ্বাস।বিশ্বাস নিজের এবং সকল মানুষের ওপর। বিশ্বাস একে অপরকে ভালো রাখার প্রতিশ্রুতিগুলিকে জীবনপণ করে পালন করার ওপর। আর সর্বোপরি বিশ্বাস ভাগ্যের প্রতি। তা থাক না সে খামখেয়ালি বিধাতাপুরুষের সাপের মুখে ফেলে দেওয়া দুএকটা দান! 

যুগের মানসিকতার সঙ্গে তাল মিলিয়েই হয়তো, রেলগাড়ির ডিব্বাগুলো তখন লালচে রঙের হতো। মরচে পড়া, চটা ওঠা লাল থেকে তাজা টকটকে লাল। মধ্যবিত্তের দিকশূণ্যপুরে হারিয়ে যাওয়ার পক্ষীরাজ। আলাদিনের দৈত্যের মতো হুকুমের অপেক্ষায়। বেশীরভাগ পথই তাকে টানতো ডিজলের ইঞ্জিন। আধুনিকতার নামে ইলেক্ট্রিক তারের দৃশ্যদূষণ ব্যস্ত স্টেশনগুলো ছাড়া বিশেষ চোখে পড়তো না। হঠাৎ কোথাও কোথাও দেখা মিলত কয়লার ইঞ্জিনের। ইয়ার্ড থেকে প্ল্যাটফর্মে ট্রেন টানার কাজ মিলেছে তার। বার্ধক্যে নুব্জ্য।  বিদায় আসন্ন জেনেও প্রাণপণ চেষ্টা করছে সভ্যতার গতির সঙ্গে তাল মেলাতে। অপমানে অভিমানে পরিশ্রমে হাঁফ ধরা মূহুর্মূহু নিশ্বাস তার। কখনো কখনো ফ্যাসফ্যাসে গলায় অনুযোগ জানাচ্ছে ডিজেল ইঞ্জিনের কাছে। হয়তো বা সাবধানবাণীও। হায় বিশ্বম্ভর রায়! হায় গওহরজান! দেহপট সনে নট সকলি হারায়! 

কাগজে মোড়া  হালকা বাদামী রঙের দুটো টিকিট। ঠাকুমার কাছে ওই কাগজের দামই বেশী।কারণ ওগুলোতেই লেখা আছে রিজার্ভেশনের টুকিটাকি। আমাদের স্বাচ্ছন্দ্যের ছাড়পত্র। আমার নজর কার্ডবোর্ডের টিকিটে। জানি অচিরেই ওগুলোর জায়গা হবে খাটের তলায় রাখা মার ভাঙা সুটকেসে। সেখানে সাতরাজার ধন আছে। তাকে পাহাড়া দেন যক্ষ স্বয়ং। 

ট্রেনে ওঠা ইস্তক ঠাকুমা-নাতির উচ্চমার্গের কথোপকথন। বলাবাহুল্য সেগুলো নিয়মের যাঁতাকল থেকে মাস খানেকের ছুটি নেওয়ার ফন্দিফিকির। সেই কথোপকথনে আকৃষ্ট হয়ে যোগ দেয় অনেক অপরিচিত মানুষও। হোক না তাঁদের সঙ্গে দেড়দিনের আত্মীয়তা! কত অযাচিত নি:স্বার্থ উপকার ও পরামর্শ! লুচির তরকারী অদল-বদল হয়। রান্নার রেসিপিও। গল্পের বই হাতবদল হয়। আলোচনা হয় দেশ সমাজ শিক্ষাব্যবস্থার। মতাদর্শ মতবাদের। 

ট্রেনের গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাল্টায় প্রকৃতিও। ধানক্ষেত, অনাবাদী জমি, পাহাড়, জঙ্গল, নদী-নালা-খাল-বিল, কুঁড়েঘর, মোষের সওয়ারি করা ছেলে, কলসী কাঁখে জল আনতে আসা মেয়ের দল, লাঙল কাঁধে ঘরে পথে চাষী। ঠাকুমা গল্প বলেন। জাতকের গল্প। বীরসামুন্ডার গল্প। শিবাজীর গল্প। জানলার বাইরে আকাশ। আকাশের রং বদলায়। কমলা, লাল, বেগুনী, আশমানি, নীল, গাঢ় নীল, কালো।সূর্য ডুবে গেলে মাঠের ওপরে কালপুরুষ দেখা যায়। যে কালপুরুষ আমার খুব আপন, আমার বাড়ির ছাদের ওপরে যার বাস, সেও আমার সহযাত্রী। চলেছে পরমবন্ধুর মতো। তারপর ভোর আসে ইগতপুরী কিংবা ভুসোয়ালে।  হুমদো হুমদো কালচে পাহাড়গুলোর পেট ভেদ করে সুরঙ্গপথে ছোটে ট্রেন। আলোআঁধারির লুকোচুরি চলে। পাহাড় থেকে নেমে আসে শিবাজীর সৈন্য। সে কি যুদ্ধ বিজাপুরীদের সঙ্গে! আমিও সদাশিবের মতো শিবাজীরই দলে। দেশোদ্ধার করতে হবে না? 

অবশেষে ঠাকুমার ডাকে ঘুম ভাঙে। দাদর স্টেশন এসেছে। জ্যাঠামশাই দুজন কুলী নিয়ে দাঁড়িয়ে। বাবা টেলিগ্রাম করে দিয়েছেন। একডজন জিনিশের সংবাদ সমেত! জ্যাঠামশাইয়ের মুখও বাবার মতোই ভার! 


২২শে ডিসেম্বর ২০১৮
আসানসোল

Comments

  1. সত্যি - "গতজন্ম বলেও ভুল হয়"

    চলতে থাকুক......

    ReplyDelete
  2. Suru ta bhalo hoyeche.. aro kichur opekhhai thaklam

    ReplyDelete
  3. খুব ভালো হয়েছে। লিখে চলো বন্ধু, আরও গল্প শুনতে চাই

    ReplyDelete
  4. নতুন গল্পের অপেক্ষায় রইলাম

    ReplyDelete
  5. খুব ভালো লাগলো পরে। সুন্দর সাবলীল লেখনি। আরো কিছু পাওয়ার আশা রইল। শুভেচ্ছা।

    ReplyDelete
  6. বিশ্বাস রইল, এই একইভাবে পরের লেখাগুলোও নিছক কলাকৈবল্য বাদ দিয়েই হবে। জেরোম - সেরম না, আমাদের মতন...
    পক্ষপাতদুষ্ট উক্তি না... চালিয়ে যা।

    ReplyDelete
  7. আগে পড়েছিলাম। এখন আবার নতুন করে পড়লাম। বেশ ভাল হচ্ছে।
    তোর ঠাকুমার মত মানুষ খুব কম জন্মায়।

    ReplyDelete
  8. khub valo laglo re jayanta ..........

    ReplyDelete

Post a Comment