রূপকথার ডালপালারা



আকাশে ভেলা ভাসিয়ে ভোকাট্টা ঘুড়ির দল দক্ষিণ দিগন্ত বরাবর যেখানে হারিয়ে যায়, সেখান থেকে আরো দুই কি তিন ক্রোশ পথ গেলেই তেপান্তরের মাঠের শুরু। মাঠ পেরলেই রূপকথার দেশ। সুয়োরাণী-দুয়োরাণী, রাজপুত্তর-রাজকন্যে, ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমী, বুদ্ধু-ভুতুম, রাক্ষস-খোক্কস, ময়ূরপঙ্ক্ষী নৌকা-পক্ষীরাজ ঘোড়া আর চাঁদের বুড়ির চরকা। ছোটবেলায় এই ছিল গভীর বিশ্বাস। 

পথের সন্ধান দিতে পারে নি কেউ। শুধু হেমন্তের তারাখসা আলোয় আর শীতেরউত্তরে হাওয়ায় গা ভেজানো নরম রোদে অলস বেহিসেবী সময়গুলো প্রবলভাবে জানান দিয়ে গেছে রূপকথার দেশ একটা আছেই। যেখানে সব স্বপ্ন সত্যি হয়। সব স্বপ্ন। সব শুভ আকাঙ্খা। 

স্বপ্নবিলাসের এই সুখের স্মৃতিটুকুই তো জীবনের মূলধন! জীবন মানে আসলে রূপকথাগুলোর পেছনে ছুটে চলা। রূপকথারা আসলে বড়োদের জন্য। শৈশব তো তার শিকড়মাত্র! আমৃত্যু প্রত্যেকদিন আমাদের মধ্যে রূপকথারা ডালপালা ছড়ায়। বাস্তবতার  মরুভূমিতে মরীচীকার মতো। মনখারাপকরা একলা বিকেলবেলায় ক্যাম্বিস বলের মতো। কুয়াশা ঢাকা  সকালে হঠাৎ এক চিলতে কাঞ্চনজঙ্ঘার মতো। 

এইসব রূপকথার অনেক রূপ। সরস্বতী পুজোর দিন সদ্য ফুলপ্যান্ট আর প্রথম শাড়ীর চকিত চাহনিতে। নাতি-নাতনির বিয়ের দিন দিদিমার জমিয়ে রাখা আংটি কিংবা কানপাশায়।আশ্বিনের শেষে উলের কাঁটায়।নিশুতি রাতে প্রকান্ড বাড়িতে কোনো একলা বৃদ্ধার সন্তানের ছবি হাতে দীর্ঘনি:শ্বাসে। মূমূর্ষু কোনো প্রিয়জনের দুর্বল হাতখানি ধরে একটুখানি নাড়ির প্রতীক্ষায়। আমরা সক্কলে আরো একটা রূপকথার অপেক্ষায় থাকি। জীবন মানে আসলে নটে গাছটি না মুড়োনো অনেকগুলি রূপকথা। 

তবু ভরসা থাকুক তেপান্তরের মাঠে। ভরসা থাকুক দক্ষিণারন্জন-লালবিহারী-অবন ঠাকুর আর হান্স আ্যান্ডারসনে। ধুলোজমা কোনো এক শারদীয়া সংখ্যার লীলা মজুমদারে। আদো আদো গলায় হঠাৎ শোনা বীরপুরুষ আবৃত্তিতে। ভরসা থাকুক ইউটোপিয়ায়। ভরসা থাকুক ডেভিড গোলিয়াথের যুদ্ধে। কিছু কিছু রূপকথারা সত্যিও তো হয়! 

Comments