শিকড়





অতলস্পর্শী ঘুম ঘুম অন্ধকারের মাঝে হঠাৎ জিয়নকাঠির আলতো ছোঁয়া। আলসেমী ভাঙানো শঙ্খধ্বনি। নহবতের সানাই। কোরাসে চন্ডীবন্দনা। আর তারপরই জলপ্রপাতের দুর্বার ধারার মতো আছড়ে পড়া আবেগঘন তৎসম বাংলায় কথকতা - চন্ডীপাঠের সুরে সুরে। আশ্বিনের শারদপ্রাতের সেই আলো-আঁধারির লুকোচুরির মাঝে কখন যে ঝুপ করে পুজো এসে পড়তো! তিথি নক্ষত্রের হিসেবে তার একটা দিনক্ষণ ছিল নিশ্চয়। কিন্তু সাড়ে চার প্রজন্মের বাঙালির শিরায় ধমনীতে সেই মূহুর্তের ফ্রিজ শট হয়ে আছে আকাশবাণীর অলৌকিক সম্প্রচারে। 

তার পোষাকী নাম "মহিষাসুরমর্দ্দিনী"। কিন্ত আবালবৃদ্ধবনিতা, সক্কলে, ভালোবেসে বলতো "মহালয়া"। আগের রাতের প্রবল তোড়জোরের পর, অতিরিক্ত উত্তেজনায় ঘুম আসতো দেরীতে। রাত পেরলেই পুজো পুজো গন্ধ। আকাশটা আরো নীল। মেঘগুলো আরো সাদা। আরো চন্চল। শিউলিগাছের গোড়াতে আরো খানিকটা জমাট বাঁধা কমলায় ছোপানো সাদা রঙের স্তুপ। না-উল্টানো শারদীয়া পত্রিকার অবিরাম হাতছানি। ছিটের কাপড়ে দুই ভাইয়ের একইরকম জামা। দুটো হাফ প্যান্ট। দুটো ফুল প্যান্ট। না সাধা গলায় পাশের বাড়ি থেকে ভেসে আসা আগমনীর সুর। আর একটুখানি অবসর। 

দেরীতে ঘুমোনোর জন্যই হোক কিংবা স্বভাব আলস্যর জন্য - ছোটবেলায় সম্পূর্ণ অনুষ্ঠান শোনার স্মৃতি খুবই আবছা। নেলকোর ইয়াব্বড়ো রেডিওর হলদে পানা আলোয় মাখা বিছানায় শুয়ে শুয়ে ঘুমের সঙ্গে নিরন্তর যুদ্ধ। বাবা-মা-ঠাকুমার সঙ্গে তন্দ্রার রাজ্যে চকিতে হানা দিতেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ-মানবেন্দ্র-দ্বিজেন-সুপ্রীতি ঘোষেরা। ক্ষোভে, দু:খে, অপরাধবোধে মিনিট খানেক চোখ খুলে থাকা। তারপর আবার পাপ ও পাপস্খালনের পুন:পৌনিকতা। অবশেষে পাকাপাকিভাবে জাগরণ রূপং দেহির সুরে সুরে। তখন আলো ঝলমলে আকাশ। মশারী পাট করার পালা। বড়োদের সামনে রাখা কাপে চা আর অল্পই অবশিষ্ট। 


এরকম মূহুর্তেই বোধহয় স্টেশনে স্টেশনে দূরপাল্লার কোনো ট্রেন এসে দাঁড়ায়। প্রবাসী মানুষগুলোর পা চিনে নেয় নিজের গলির মোড়। ফেলে আসা ভাড়াবাড়ি। চিলেকোঠার ছাদ। কয়লার গাদা। মধ্যবিত্ত দৈন্য। গলি ক্রিকেট। আঁচলে হলুদের দাগ। আর সাদা কমলায় মাখামাখি শিউলির স্তুপের অনেক অনেক নীচে মাটিকে জাপটে ধরে থাকা শিকড়ের অস্তিত্ব। 

Comments

  1. ভাই খুব সুন্দর .....................।।

    ReplyDelete

Post a Comment