লোডশেডিং



তখন আকাশের রং নীল ছিল। পাশের বাড়ির দোতলার ছাদে উঠে দক্ষিণদিকে চোখ রাখলে পরিষ্কার দেখা যেত বিহারীনাথ পাহাড়। বাড়ির উঠোনে এক্কাদোক্কা খেলতো চড়াই আর শালিক পাখির দল। বাজারফেরত দশ পয়সা আর কুড়ি পয়সারা জমা পড়তো লক্ষ্মীর ভাঁড়ে। তখনো ডোডো পাখির মতো বিলুপ্ত হয় নি তোলা উনুন-ঘুঁটে-কাঠকয়লা; রেশনের দোকানের কাঁকড় মেশানো চাল, পাতলা পত্রালী খাতা আর ঘোড়ামার্কা দেশলাই। ছিল শ্রেণিহীন সমাজের স্বপ্নও। আর এসবের সঙ্গেই, বঙ্গজীবনের অঙ্গ ছিল লোডশেডিং। 

লোডশেডিং মানে আজকের স্মার্ট, ভুঁইফোড় পাওয়াকাট কিংবা কেবল ফল্ট নয়। আভিজাত্যে ও গরিমায় মধ্যবিত্তের সংসারে তার স্থান ছিল নিবিড় এবং দৈনন্দিন। সে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের মতোই অবশ্যম্ভাবী, কিন্তু শরতের বৃষ্টির মতো খামখেয়ালী। সে আসতো বিনা নোটিসে, চৈত্রশেষের কালবৈশাখীর মতো পাগলাঘোড়ায় চেপে। নিয়তির করালগ্রাসের মতো অনিভেপ্রত ছিল তার আসা। খানিকটা গ্রীক নাটকের ট্র্যাজেডির মতো। তবু সে আসতো। আসতোই। 

শিবঠাকুরের যেমন ষাঁড়, দেবীদুর্গার সিংহ; লোডশেডিং এর দেবতা আসতেন হ্যারিকেনে চেপে। প্রদীপ, পিলসুজ, লন্ঠন, মোমবাতি, টর্চ - আলো জ্বালাবার যে ফিকিরই বলুন না কেন, বাঙালীর জীবনে হ্যারিকেনের জায়গা একমেবাদ্বিতীয়ম। বাড়িতে পুজো-আচ্চা থাকলে ঠাকুরমশাইয়ের ফিরিস্তিমতো ব্যবস্থা করা যেমন সাংসারিক দায়বদ্ধতা, দুপুর গড়িয়ে বিকেল এলে লোডশেডিং এর আগামপ্রস্তুতি অবশ্যকর্তব্যের মধ্যে একটি। তেলটেল ভরে, কাঁচে আগের দিন লেগে থাকা ভুসোকালির ছোপগুলো পাতলা ন্যাড়া দিয়ে পরিষ্কার করে, বাসররাতের কনের মতো সাজিয়ে গুজিয়ে রাখা হতো হ্যারিকেনগুলোকে। মোমবাতির ব্যবহার ছিল আপতকালীন এবং স্বল্পমেয়াদী। আজকের সুখী সুখী সাইজ জিরো মোমবাতি নয়, মধ্যবিত্তের টানাটানির সংসারের দায়গ্রহন করতো ইঞ্চি আটেক লম্বা,  মোটাসোটা মোমবাতিরা। আদ্ধেক হলে সেগুলোর জায়গা হতো রান্নাঘরে বা বাথরুমে, স্থানবিশেষে সরাসরি মেঝের ওপর অথবা ফেলে দেওয়া চায়ের কাপ অথবা শিসির ওপর চেপে। 

প্রকৃতির অলঙ্ঘনীয় নিয়মের মতো লোডশেডিং এর থাবা আছড়ে পড়তো নানা কাজের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে। এই ধরুন দুলকি চালে পড়তে পড়তে দেড় পাতা জোড়া কবিতা টা যখন মনে হচ্ছে প্রায় মুখস্ত হয়ে এলো এলো। কিংবা তৈলাক্ত বাঁশে উদ্দেশ্যহীনভাবে ক্রমাগত ওঠানামা করা কেসি নাগের অসভ্য বাঁদরটা কে যখন আপনি প্রায় বশ করে এনেছেন। অথবা আপনার হাতের রেখায় ব্যাঙের পৌষ্টিকতন্ত্র যখন তার অস্তিত্বের সার্থকতা খুঁজে পাচ্ছে। অথবা গীতবিতানটা খুলে মা ঠিক যখন ভুলে যাওয়া কোনো গানের লাইন অনুসন্ধানে ব্য়স্ত। সারাদিন গলদঘর্ম হয়ে ফিরে বাবা যখন সকালের অপঠিত উত্তরসম্পাদকীয়র সঙ্গে মনে মনে তর্ক জুড়বেন জুড়বেন।কিংবা অতি খারাপ একখানি উত্তরপত্রে, পাশ-ফেলের দোলাচলের মধ্যে ঠাকুমা যখন সবে মাত্র মানবিক কোনো সিদ্ধান্তে প্রায় পৌঁছবেন।  পাড়ার মোড়ের অখন্ড তাসের আসরে যখন তুরুপের তাসটা বেরবে বেরবে করছে। অগোছ বদনাম দূর করার জন্যই হয়তো, পিসিমা যখন আলমারী থেকে সব কাপড়জামা মেঝেতে আর খাটে ডাঁই করে সাজিয়েছেন। লোডশেডিংএর দেবতা ঘাপটি মেরে সব দেখতেন। তারপর মোক্ষম সময় বুঝেই খপাত।

লোডশেডিং হলেই প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হিশেবে মুখ দিয়ে একটা শব্দ বার হতো। শব্দটা রাগ-বিরক্তি-হতাশার এবং একালের হাইকোর্টের শব্দদূষণ সম্পর্কিত নির্দেশিকাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, পরিবারের সমস্ত সদস্যদের এবং পাড়াপ্রতিবেশীদের সম্মিলিত সেই শব্দ, গণ হাহাকারের রূপ নিত। প্রাথমিক ধাক্কা সামলে ওঠার পর সংসারের মাতব্বরেরা লোডশেডিং এর রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা দিতেন। গিন্নীরা নিজেদের কপালকে দুষতেন। প্রাচীনরা বিগতযুগের জয়ধ্বনি দিতেন। শুধু কচিকাঁচারা মহাফূর্তিতে লোডশেডিং কে বরণ করে নিত। 

তারপর ঘরে ঘরে জ্বলে উঠতো হ্যারিকেন। হাতে হাতে ঘুরতো হাতপাখা। কথোপকথন ছড়িয়ে পড়তো এ ঘর থেকে ও ঘর, এ জানলা থেকে ও জানলা, এ উঠোন থেকে ও উঠোন। কৃত্রিম আলোয় যে দেওয়ালগুলো দেখা যেত, অন্ধকারে সেগুলো সব ভ্যানিশ! লোডশেডিং এর কল্যাণে পুরো পাড়াটা হয়ে উঠতো বিশাল এক যৌথ পরিবার। 

তখন হাস্নুহানার ঝোপ থেকে জুজুরা একে একে বেরিয়ে পড়তো। তারার আলোয় উড়তো পক্ষীরাজ ঘোড়া আর ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমী। সপ্তর্ষিমন্ডলে বশিষ্ঠর পাশে অরুন্ধতীকে দেখা যেত স্পষ্ট করে। আর দক্ষিণ দিগন্ত থেকে গলা বাড়িয়ে, নিভে থাকা স্ট্রীট লাইট গুলো ছাড়িয়ে, বিহারীনাথ ছাড়িয়ে, অনেক অনেক দূর থেকে আলো দেখাতো অগস্ত্য়। 

Comments

  1. অন্ধকারেও যে আলো থাকে, তাকে চিনলাম। খুব ভালো, উদ্ভাসিত

    ReplyDelete

Post a Comment