বিপদে মোরে রক্ষা করো



স্কুলের মূল প্রবেশপথের বাঁ দিকে আমতলা। আমতলার পাশে ঠাকুরদালান। তার ওপর মন্দির। মন্দিরে ঢোকার দুটো কাঠের দরজা। বাঁ দিকের দরজা দিয়ে প্রবেশ করলেই শ্রীরামকৃষ্ণ, সারদাদেবী আর স্বামী বিবেকানন্দের মূর্তি। সেখান থেকে যদি ডান দিক বরাবর মন্দিরের দেওয়াল ধরে প্রদক্ষিণ করা যায়, দেখতে পাবেন শ্রীরামকৃষ্ণের বাকী ষোলজন শিষ্যের ফ্রেমে বাঁধানো ছবি - সারিসারি দেওয়ালে টাঙানো। তারপর অদ্বৈত বেদান্তের ঐতিহ্যে আলতো টুকি দিয়ে শঙ্করাচার্য্য হয়ে শেষ স্টেশন এই বিবিধ রতনের বঙ্গভূমির শ্রীচৈতন্যমহাপ্রভুতে।ডানদিকের দরজার কোণে চরণামৃতের পাত্র আর প্রণামীর বাক্স। এইরকমই ছিল ব্যবস্থা।

বছরের অন্যান্যদিন আম ভক্তদের টুকিটাকি চাহিদা মেটানো ছাড়া এইসব মহাপুরুষদের কাজ ছিল বছরে তিনবার ছাত্রদের পরীক্ষার বৈতরণী পার করানো। অঙ্ক আর ইংরেজীর দিন ভক্তির মাত্রাটা একটু বেশীই থাকতো। চরণামৃত ও শেষ হতো তাড়াতাড়ি। বাংলা আর ভূগোলের দিন নমো নমো করে পেন্নাম সারা হতো। আর ওয়ার্ক এডুকেশনের দিন বেচারাদের বিশেষ কেউ পাত্তা দিত না। 

তাঁর নামাঙ্কিত স্কুলের জন্যই হয়তো, শ্রীরামকৃষ্ণের মূর্তির সামনে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার দিন প্রণামের সময়টা একটু বেশীই বরাদ্দ থাকতো। ব্যক্তিত্ব, পরীক্ষার বিষয় এবং প্রস্ততির সঙ্গে সামন্জস্য রেখে আকূতির শারীরিক বিভঙ্গও বিভিন্ন। কেউ সাষ্টাঙ্গে নট নড়ন চরন। কেউ পদ্মাসনে ধ্যানমগ্ন যোগী - পায়েস হাতে সুজাতার অপেক্ষায়। কারোর ইস্টাইল আবার দাঁড়িয়েই দাঁড়িয়েই অনবরত পেন্নাম ঠোকা। পরীক্ষায় লেখার ক্লিপবোর্ড সহ।! ওইটিই রণভূমি কিনা! 

সারদাদেবীর জীবনমাহাত্ম্য ওই বয়সে কজন বুঝতো জানি না। হয়তো কেউ কেউ ভাবতো লক্ষ্মী-নারায়ণের মন্দিরে যেমন একজনকে পেন্নাম করা সখত বেয়াদপি, এখানেও সেরকমই দস্তুর। মোদ্দা কথা সারদাদেবীর মূর্তিও তার বরাদ্দ ভক্তি পেত। স্বামী বিবেকানন্দের কথা তো নতুন করে বলার নেই। অমন তেজস্বী পুরুষসিংহের ছবির সামনে দাঁড়ালে ভক্তিভাব এমনিই আসে। কিন্তু প্রার্থনা ও ভক্তির সামন্জস্য নষ্ট হতো তাঁর গুরুভাইদের ছবির সামনে। স্বামী ব্রহ্মানন্দের ছবি থাকতো বিবেকানন্দর ঠিক পরেই। ভক্তির রেশ ধরে রেখে তাঁর ছবির সামনে যদিবা আধামিনিট মাথা ঠেকানো হতো, ধৈর্যচ্যুতি হতো ঠিক তার পরের ছবির সামনেই। হয়তো ছাত্রদের নাস্তিক সত্ত্বা জেগে উঠে মনে করাতো এসব ধর্মের খাতে বাজে সময় নষ্ট। হয়তো পড়ার বইয়ের কোনো একটা বিশেষ অংশ মনে পড়ে যেত, যেগুলো গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্বেও আলস্যবশত কাটিয়ে গেছে লোকে। হয়তো মন্দিরের সামনে খুলে আসা জুতোটার কথা মনে পড়তো। নতুন কেনা নটিবয় শ্যু। কারণ যাই হোক, ফলাফল এরকমই হতো। 

সর্বস্ব না হারিয়ে যেমন পাশা খেলা থেকে উঠতে নেই, মন্দির পরিক্রমাও ওরকম দুম করে মর্জিমাফিক বন্ধ করা যায় না। কাজেই উল্টি গিনতি করতে করতে শ্রীচৈতন্যের ছবির নীচে দাঁড়ানো মাত্রই ছাত্ররা বুঝতে পারতো মহাপুরুষ কম পড়িতেছে। ওদিকে আবার শ্রীরামকৃষ্ণের সাক্ষাৎ শিষ্য এবং স্বামীজীর গুরুভাইদের প্রতি অবহেলা যে পরীক্ষার খাতায় কিরকম প্রভাব ফেলবে ভেবেই অনেকের আত্মারাম টনসিলকে ঠেলাঠেলি করতো। বলা তো যায় না, বিশ সেকেন্ড মাথা ঠেকানোয় স্বামী শিবানন্দ যদি ত্রিকোণমিতি উদ্ধার করতে পারেন, মাত্র পাঁচসেকেন্ড বরাদ্দ রাখায় স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ পাটিগণিতে কাঠিও করতে পারেন! অতএব, মহাপ্রভুর ছবির সামনে চলতো পাপস্খালন এবং প্রায়শ্চিত্ত। কিন্তু ভাবের জোয়ার ভাঁটায় এবং গণআকূতির সামনে তাঁরও মাঝেমধ্যে ভুল হয়ে যেত। আর আপনিও  গ্রামার কম্পোজিশনে টকাটক নাম্বার তুলে প্রেসি তে গিয়ে দাঁতকপাটি। 

সবথেকে ভয়ানক ব্যাপার যখন দেখতেন আপনার ঠিক আগে দাঁড়ানো সহপাঠীটি চরণামৃতের পাত্র থেকে বরাদ্দের অতিরিক্ত পান করছে এবং আপনার জন্য একফোঁটাও বাকি রাখে নি। তার ওপর অগ্নিদৃষ্টি বর্ষণ করে আপনি হয়তো চামচটাকে আলগোছে মুখের ওপর এনে চরণামৃতের বাষ্প গলায় ঢাললেন, কিন্তু মনে খুঁত রয়েই গেল। কারণ ঠাকুমা দিদিমাদের কাছে রূপকথার গল্পে আপনি শুনেছেন, ঠিক এই রকম পরিস্থিতিতেই সুয়োরাণীরা রাজপুত্রের জন্ম দেয়, আর দুয়োরাণীরা বাঁদর কিংবা পেঁচার। 

Comments