ছবি স্মৃতি এবং উপলক্ষ্য

বাড়িতে একটা ইয়া মস্ত একটা প্রতিকৃতি ছিল রবীন্দ্রনাথের। ফটোগ্রাফ বা পেন্টিং নয়। কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো চীনে সুতোর কাজ। বুক অবধি সাদা লম্বা দাড়ি। পরনে আলখাল্লা। মোনালিসা-মার্কা জানি কিন্তু বলব না গোছের হাসি হাসি মুখ। বেশ ঠাকুর্দা ঠাকুর্দা গন্ধ। আবার ঠাকুর ঠাকুর ও। 

বন্ধুরা বলতো পাপ করে ফেললে ঠাকুরের সামনে স্বীকার করে নিতে হয়। ঠাকুর নাকি সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমা করে দেন। বন্ধুদের বাড়িতে ঠাকুর দেবতার ছড়াছড়ি। হামাগুড়ি দেওয়া গোপাল থেকে শুরু করে বাঁশী হাতে রাধা সমেত কৃষ্ণ, সপরিবারে মা দুগ্গা, জিভ ভ্যাংচানো মাকালী আর পারিবারিক গুরুদেব। যদিও সেই গুরুদেব কে দেখতে রবীন্দ্রনাথের মতো সুন্দর নয়, কিন্তু বন্ধুরা বলতো ওসব কথা নাকি মুখেও আনতে নেই। সে যাই হোক, মোদ্দা কথা বন্ধুদের পাপস্খালনের সুযোগ অনেক। আমার ঠাকুর বলতে ওই রবীন্দ্রনাথই ভরসা। দুপুর বেলা গোপালের বদলে রাখাল হয়ে গুঁড়ো দুধ বা কুলের আচার সরানোই হোক কিংবা পড়ার বরাদ্দ সময়ের মধ্যে টুক করে একফালি লীলা মজুমদার - গুরুদেব আমার শৈশবের সমস্ত খুচরো পাপেরই হিশেব রাখতেন। 

প্রত্যেক বছর ২৫ শে বৈশাখের দিন পা়ড়ার কাকুরা প্রতিকৃতিটা নিয়ে যেত রবীন্দ্রসরণি তে। প্রথম প্রথম এবষয়ে আমার দুশ্চিন্তার অন্ত ছিল না। বিশ্বকর্মা, দূর্গা, মাকালী, সরস্বতী, অন্নপূর্ণা - পুজো হয়ে গেলেই আসছে বছর আবার হবার আশ্বাস দিয়ে সবাইকে চ্যাংদোলা করে জলে ফেলে দেওয়া হয়। বার্ষিক পজো-আচ্চার পর রবীন্দ্রনাথই বা যে কেন ব্যতিক্রম হবেন তার যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা আমার কাছে অন্তত: ছিল না। কাজেই যখন দেখতাম অন্যান্য ঠাকুর দেবতার জন্য বানানো আইনকে  বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ২৬শে বৈশাখ ও রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতি আমাদের বাড়িতে স্বমহিমায় বিরাজ করছেন, বিশ্বাস করুন, তার আনুভূতিক মূল্য অরণ্যদেবের প্রতি সুপারহিরোসুলভ মুগ্ধতার থেকে বিন্দুমাত্র কম ছিল না। ভাবতাম কবিগুরুর সঙ্গে ঠাকুর ও তো বটেন! 

সত্তরের দশকে মফস্বল শহরের মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে জন্ম নেওয়া মাত্রই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আপনার অচ্ছেদ্য সম্পর্ক। আপনার দাদু-ঠাকুমার মধ্যে কেউ না কেউ রবীন্দ্রনাথকে চাক্ষুষ করেছেন। আপনার বাবা-মার বড়ো হয়ে ওঠা রবীন্দ্রশতবার্ষিকীর ঢেউয়ে। সে সম্পর্ক আরো আঁটোসাঁটো হয় যদি গীতবিতান থেকে পাশ করা আপনার মা যদি কারণে অকারণে রবীন্দ্রনাথ গুনগুন করেন। অলস দুপুরে "শিশু" কন্ঠস্থ করান। বাবার অবসর কাটে রেডিও কিংবা রেকর্ড প্লেয়ারে দেবব্রত-কণিকা-সুচিত্রা-গীতা ঘটকে। মোটামোটা বই পড়ার ফাঁকে ফাঁকে ঠাকুমা "বীরপুরুষ" কিংবা "প্রশ্ন" আবৃত্তি করতে শেখান। তার ওপর যদি পাশের ঘর থেকে অসীমদাদাদের আলোচনা কানে আসে, কচি বয়স থেকে আপনার রবীন্দ্রানুরাগ ঠেকায় কে! 

তারপর বড় হওয়ার সাথে সাথে জোয়ার আসে চিন্তাজগতে। একূল ওকূল ভাসানো চিন্তা সব। বয়সোচিত কারণে কিছু কিছু চিন্তা প্রতিষ্ঠানকে টান মেরে ফেলে দেওয়ার। সে ভয়ানক মন্থনে বেচারা রবীন্দ্রনাথও হাবুডুবু খান। তারপর হাঁটিহাঁটি পায়ে কৈশোর পেরিয়ে যৌবন। যৌবন পেরিয়ে প্রৌঢ়ত্বের হাতছানি। পরিচিত স্নেহভরা বলিষ্ঠ হাতগুলো প্রকৃতির নিয়মেই আস্তে আস্তে বিলীয়মান। সংবাদপত্রথেকে  প্রতিদিন সকালে দুর্গন্ধ ছড়ায়। জীবনপণ দাবি করা মতবাদগুলোর কঙ্কাল দেখা যায়।  তখন হঠাৎ চীনে সুতোর কাজ করা রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতির সামনে দাঁড়াতে ইচ্ছে করে। ঘন কালো মেঘের ফাঁকে সূর্য হাসে ফিক করে। বালির স্তুপের ওপারে মরূদ্যান দেখা যায়। হয়! হয়! চুপ করো অবিশ্বাসী! কথা কয়েও না! 

 ।। আসানসোল ।।
।। ১২ ই মে ২০১৯।।

Comments