মাস্টার

কালো কুচকুচে গায়ের রং। গোলপানা মুখ। কখনো গরমকালের দুপুরের টলটলে দীঘির মতো মসৃন ভাবে কামানো। কখনো বা ট্রেনের জানলা থেকে দেখা হেমন্তের ধান ক্ষেতের মতো খোঁচাখোঁচা দাড়ি গোঁফ। খুতনির নীচে ডাবল চিনের আভাষ। চোখে মোটা কালোফ্রেমের বাইফোকাল চশমা। পরনে কখনো হাল্কা নীল, কখনো বা ময়লাপানা হলদেটে পান্জাবী আর তার থেকে দু পোঁচ কালো আটপৌরে ধুতি - কোনোদিন হয়তো যেটা সাদা বলেই কেনা হয়েছিল। চুলের ক্রমবর্ধমান অপ্রতুলতা সত্ত্বেও সপ্তাহের প্রথমদিনগুলোতে পাড়ার মোড়ের নাপিতের অভিজ্ঞ হাতের কলপের কারুকার্য সুস্পষ্ট। ওটুকুই যা বিলাসিতা! আর বিলাসিতা বলতে কখনো সখনো ক্যাপস্টান সিগারেটের দুএকটা সুখটান। আর সর্বোপরি বুকের পাঁজরের অনেক অনেক নীচে জমিয়ে রাখা স্কুলে চাকরি করার এক চিলতে একটা অহঙ্কার। অব্যক্ত, কিন্তু মুখর। জাগ্রত, কিন্তু সমাহিত। নির্লিপ্ত, কিন্তু আসক্ত। 

পাড়ার মাতব্বররা বলতেন মাস্টার। যদিও মাইনের দিন আর ইস্কুলের বার্ষিক পত্রিকায় তাঁর নাম থাকত শিক্ষাকর্মীদের তালিকায়। স্কুলের অফিসঘরের টাইপরাইটার আর কাগজপত্রের জঙ্গলই তাঁর কর্মভূমি। টুকিটাকি ভাউচার। হিশেব নিকেষের খাতা। নতুন ক্লাসের বুকলিস্টের প্রুফ। স্পোর্টসের দিন জিলিপি কেনার টাকা। নোটিসের খাতায় লেখা ছুটির হদিশ। ছোট টিফিনে একটা ঘন্টা। ঢং করে। বড়ো টিফিনে পেতলের ঘন্টায় হাতুড়ির অনুরণন ক্ষিদে চাগাড় দিয়ে তোলে। ছুটির ঘন্টার সবটা শোনাই যায় না ছাত্রদের উচ্ছ্বাসে। তারপর বাড়ি ফেরার পালা। সন্ধ্যেবেলা ঠাকুরের নামগান করতে করতে চুপিচুপি আরো একবার সত্যি সত্যি মাস্টার হওয়ার প্রায় তামাদি হয়ে যাওয়া আর্জিটার পরিমার্জনা। আরো একটুখানি সম্মানের আকাঙ্খায়। 

প্রবল বৃষ্টির দিনে, যেদিন অনেক মাস্টারমশাই অনুপস্থিত, কখনো কখনো অবশ্য তাঁর শিকে ছিঁড়তো। ক্লাস ফাইভের ভূগোল ক্লাসে। ক্লাস থ্রীর সাধারণ জ্ঞান। স্কুলের নামকরা শিক্ষকরা যেসব খেপ কখনোই খেলবেন না, তাঁকে পাওয়া যেত হাসিমুখে। ঠাকুরের উদ্দেশ্যে প্রণাম জানিয়ে তিনি ভাবতেন এইবার বোধহয় তিনি মুখতুলে চাইলেন। এবার বুঝি সময় এল নিজেকে প্রমাণ করার। 

কিন্তু ছেলেরা, সে যে ক্লাসেরই হোক, কোন শয়তানের মন্ত্রবলে যেন, তিনি ক্লাসে ঢুকলেই হোওওও করে চেঁচিয়ে উঠতো। কে যেন একবার আলকুষীও রেখেছিল ডেস্কের ওপর। আর নীল পান্জাবীর পিঠের ওপর গাঢ় নীল কালির দাগ, সেটা যে কখন কে দিয়েছে তা বোঝাই হয়ে ওঠেনি কখনো। আড়ালে তারা বলতো হাফ-মাস্টার। 

হয়তো তেল ও কলুর বলদ সম্পর্কিত বহুল প্রচলিত প্রবচনটি সত্যি প্রমাণ করার জন্যই হয়তো, তাঁর ঠাঁই হতো অফিসঘরের কোণটিতেই। তিনি চুপ করে শুনতেন - প্রথম পিরিয়ডের ঘন্টা, দ্বিতীয় পিরিয়ডের ঘন্টা, ছুটির ঘন্টা। 

তাঁর অবসরের বছর খানেক আগে, ঈশ্বর হয়তো নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ করার তাগিদেই, স্কুলের সংস্কৃতের পন্ডিতমশাই কে দিলেন বছরের শুরুতেই শয্যাশায়ী করে। ইস্কুলের মাথারা অনেক পার্মুটেশন কম্বিনেশন করেও রুটিনের জটিল অঙ্ক ও রাজনীতি না মেলাতে পেরে শেষমেষ ক্লাস সেভেনের সংস্কৃত পড়ানোর ভার দিলেন তাঁর ওপর। প্রায় পুরো একটি বছর! প্রতি বুধবারের চতুর্থ পিরিয়ড। 

আদ্যিকালের বইপত্তর ঘেঁটে, একে-ওকে-তাকে ধরে সংস্কৃতর প্রস্তুতি মন্দ হলো না। শব্দরূপ-ধাতুরূপ-প্রত্যয়। চাণক্যর বাছাই করা শ্লোকের সটিক ব্যাখ্যা। ক্লাসের দিন ফরসা ধুতি পরলেন, কোঁচা দিয়ে। আদ্দিরের পান্জাবীটা ও বেরলো। সঙ্গে শাল - কাঁধের ওপর পরিপাটি করে রাখা। অফিসঘরে বসে বসে অধীর হয়ে চতুর্থ পিরিয়ডের অপেক্ষা। 

আলকুষীতে আর হাত চুলকোবে না। পিঠের নীল কালির দাগও মিলিয়ে এলো প্রায়। এবার পাড়ায় কেউ মাস্টার বললে তিনি আর কোনোদিন চোখ নামিয়ে নেবেন না। 

Comments